সমাজের তথাকথিত সুস্থ মানুষেরা নিজেদেরকে স্মার্ট গণ্য করে অপেক্ষাকৃত কম বুদ্ধিমত্তা সমন্ন মানুষের ভুলত্রুটি নিয়ে হাসিতামাশা করি, নানান বিশেষণে বিশেষিত করে এক বুনো আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠি। এই অবস্থা থেকে উত্তরনে আমাদের মধ্যে ঘুমন্ত মূল্যবোধকে জাগিয়ে তুলতে হবে। আমাদের চারিপাশের তথাকথিত সুস্থমানুষদের মাঝে সচেতনতার বীজ বপন করতে হবে। সেই মহতী কাজকে উস্কে দিতে জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন এর উপন্যাস হাউজ হাজব্যান্ড।
একাডেমিক যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও যেমন কর্ম জীবনে অনেকের মাঝে সফলতা দেখা যায় না, আবার দেখা গেছে কেউ কেউ মাঝারি একাডেমিক ফলাফল পুঁজি করে অনেকে সুন্দর ক্যারিয়ার গঠন করে চমৎকার সংসার পেতে সুখের ঢেঁকুর তুলছেন। কর্ম জীবনের সফলতা নির্ভর করে অনেক বিষয়ের উপর, যেমন কোনো ব্যক্তির একাডেমিক জ্ঞান ছাড়াও পার্থিব জ্ঞানগরীমা, চৌকষ ব্যাক্তিত্ব, বুদ্ধিমত্তার সাথে চাকুরীর ইন্টারভিউগুলো মোকাবেলা করা, কিছুটা ভাগ্য ইত্যাদি । এ তো গেল কর্ম জীবনে সফলতার কথা । সংসারের সফলতা আরো ইন্টারেস্টিং ব্যাপার।
সাংসারিক এবং একাডেমিক দক্ষতা একই সঙ্গে খুব সৌভাগ্যমান মানুষ ছাড়া তেমন একটা চোখে পড়ে না। আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, ছাত্র জীবনে একাডেমিক্যালি অনেক পেছনে থাকা বন্ধু -বান্ধবরা সংসার জীবনে চমৎকার সফলতা অর্জন করেছেন। আমি আরও দেখেছি, বাঘা বাঘা ছাত্ররা সংসার করতে এসে হিমসিম খাচ্ছেন। আবার আমি এও দেখেছি, অনেক ভালো একাডেমিক ফলাফল করেও অনেকে না পেরেছেন কর্মময় জীবনে সফলতা, না পেরেছেন সংসার জীবনের সফলতা। রহস্য ঘেরা এই পৃথিবীতে এমনই একজন চরিত্রের দেখা পাওয়া যায় আমার লেখা হাউজ হাজব্যান্ড উপন্যাসে।
উপন্যাসের নায়ক এক মেধাবী চরিত্র মাধ্যমিক পরীক্ষার পরে একটি প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত থেকে ক্যারিয়ার থেকে সাময়িকভাবে ছিটকে পড়লেও আবারও উঠে দাঁড়িয়ে বুয়েটের মতো নামিদামি ইউনিভার্সিটি থেকে আর্কিটেকচারের ওপর ডিগ্রি অর্জন করেন। কিন্তু, বাস্তবতার অমোঘ নিয়মে তিনি কর্ম জীবনে সফলতার দেখা পাননি। সফলতা তাঁর কাছে সোনার হরিণ হয়ে হাতের নাগাল থেকে ছুঁটে গেছে বার বার। এই যখন অবস্থা, এরকম সময়ে প্রায় এক যুগ ধরে প্রেমের সম্পর্ক জিয়ে রেখে সেই নায়ক এক ধনীর দুলালীকে বিয়ে করে সংসার বাঁধলেন । সেখানেও গোত্তা খাওয়া ঘুড্ডির মতো মুক্ত বাতাসে ভাসতে ভাসতে কোথায় যেন যেয়ে সূতা আটকে গেল। এই ছিঁড়ে যাওয়া ঘুড্ডির পেছনে আমাদের অগোচরে থেকে গেছে অনেক অনেক সিস্টেমিক ফ্যাক্টারের পাশাপাশি থার্ড একটি ফ্যাক্টার। সেটি হচ্ছে ‘মেন্টাল হেলথ’, যা আমার হাউজ হাজব্যান্ড উপন্যাসের মূল উপজীব্য বিষয়।
আমরা যে সময়ে শৈশব, কাটিয়েছি তখন বাংলাদেশে ‘মেন্টাল হেলথ’ শব্দটির ব্যাবহারের চল তেমন একটা দেখা যায়নি। অবশ্য পাড়াগাঁয়ে দু একটি করে ডেভেলপমেন্টাল ডিসেবিলিটি ছেলে-মেয়ে দেখা যেত। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয় স্বজনদের নানান বিদ্রুপ ও সামাজিক অসহোযোগিতার শিকার হয়ে এই বাচ্চাগুলোকে নিয়ে অনেক কষ্টে জীবনযাপন করতেন মা-বাবারা। আবার, কিছু কিছু মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষদের দেখা যেত উলঙ্গ অথবা অর্ধ উলঙ্গ হয়ে রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কখনো কখনো ছোটছোট ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে এদেরকে ‘পাগল’ পাগল বলে ধাওয়া করে ঢিল ছুঁড়ে নিষ্ঠূর মজা করছে । ঠিক এই ক্যাটাগরি ছাড়াও আমাদের আশেপাশে এমন অনেক মানুষ রয়েছে যারা শিশুকাল থেকেই কিছুটা ভিন্ন আচরণ করলেও অভিভাবকদের অসচেতনতার কারণে সেই ভিন্নতাকে আচরণগত সমস্যা মনে করে এড়িয়ে যেয়ে আরও বিপদ টেনে আনেন। এসব বাচ্চারা জীবন চক্রের বিভিন্ন ধাপে ধাপে আরও নানানবিধ জটিল পারিপার্শ্বিকতায় পরবর্তী জীবনে নিজেদেরকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার সম্মুখীন হতে দেখা যায়।
আমরা নিজেদের এবং নিজের পরিবারের মেম্বারদের কোনো শারীরিক অসুস্থতা হলে বিচলিত হয়ে ডাক্তারের কাছে ছুঁটে যাই। কিন্তু ম্যান্টাল হেলথের মতো এক অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় আমরা তথাকথিত শিক্ষিত হয়েও আমলে নেই না বা নিতে চাই না। আচরণগত সমস্যা মনে করে আর বিশেষজ্ঞগণের শরণাপন্ন হই না। যখন বেলা শেষে আমাদের টনক নড়ে তখন অনেক দেরি হয়ে যাওয়ার কারণে পস্তাতে হয়। প্রবাসী জীবনে প্রায় দশ বছর মেন্টাল হেলথ নিয়ে কাজ করতে যেয়ে আমি মানুষের জীবনের নানান টানাপোড়ন , আঁকাবাঁকা পথের দেখা পেয়েছি যা আমার হাউজ হাজব্যান্ড উপন্যাসে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
আমরা তথাকথিত সুস্থ মানুষেরা নিজেদেরকে স্মার্ট গণ্য করে অপেক্ষাকৃত কম বুদ্ধিমত্তা সমন্ন মানুষের ভুলত্রুটি নিয়ে হাসিতামাশা করি, নানান বিশেষণে বিশেষিত করে এক বুনো আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠি। সমাজের কিছু undiagnosed মেন্টাল হেলথ সম্পন্ন মানুষকে নিয়ে অহরহ বিদ্রুপ করে আমরা আমাদের নিজেদের সুস্থতাকে কি আমরা প্রশ্নবিদ্ধ করি না ? মানুষের মস্তিষ্কের রহস্যময় আচরণের পেছনের কারণ গুলোকে আমাদের আমলে নিতে হবে। প্রয়োজনে সময়মতো বিশেষজ্ঞগণের শরণাপন্ন হতে হবে। আমাদের মধ্যে ঘুমন্ত মূল্যবোধকে জাগিয়ে তুলতে হবে। আমাদের চারিপাশের তথাকথিত সুস্থমানুষদের মাঝে সচেতনতার বীজ বপন করতে হবে । হাউজ হাজব্যান্ড উপন্যাসটি এরকম এক মহতী আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের প্রয়াস।
আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে?
তোমার ছেলে উঠলে গো মা রাত পোহাবে তবে!
উল্লেখ্য, জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন। জন্ম ১৯৬৬। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে উন্নয়ন কর্মী হয়ে দেশীয় ও আন্তজার্তিক অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরী শুরু করেন এবং তখন থেকেই লেখালেখিতে মনোনিবেশ। তবে লেখালেখি শুরুটা ছিল সেই হাইস্কুল জীবনে পাড়ার বড় ভাইদের প্রকাশিত ম্যাগাজিন ‘অবসর’ নামক পত্রিকার মাধ্যমে। ২০০৩ সালে কানাডায় সপরিবারে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করে, আবারও পড়াশুনা, প্রথম Humber College থেকে সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে দুই বছরের ডিপ্লোমা, পরে University of Guelph থেকে ফ্যামিলি & কমিউনিটি সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে আবারও উন্নয়ন কর্মী হিসাবে রেজিস্টার্ড সোশ্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার হিসাবে ২০১০ সাল থেকে অদ্যাবধি টরেন্ট ভিত্তিক বিভিন্ন অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর করছেন । লেখকের কয়েকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক গল্পপ্রবাসী ব্লগ, কানাডা ভিত্তিক একটি সাপ্তাহিক বাংলামেইল পত্রিকায় এবং মাসমিডিয়াতে ব্যাপক সাড়া পাওয়ার পরে ঢাকায় ২০২৩ সালের একুশে বইমেলায় লেখকের তিনটি বই হোমলেস, সিঙ্গেল মাদার, জোসনা ম্যানশন উপন্যাস আকারে প্রকাশিত হয় । বর্তমানে হাউজ হাজব্যান্ড নামে লেখকের আরেকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক কে উপন্যাস হিসাবে ২০২৪ সালের ঢাকা একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে । মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখকের একটি জনপ্রিয় গল্প ‘শেকড়’ ২০২১ সালে বাংলাদেশের বুকল্যান্ড প্রকাশনা থেকে ৫০ লেখকের ভাবনা নিয়ে পঞ্চাশে বাংলাদেশ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল। গল্প/উপন্যাসের পাশাপাশি কবিতা, প্রবন্ধ লেখা ছাড়াও খেলাধুলা নিয়েও লেখকের অনেক লেখা রয়েছে।