গত ২৬ জানুয়ারি নিউইয়র্কের কনি আইল্যান্ডের একটি বড় অডিটোরিয়ামে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত প্রবাসীদের অন্যতম বৃহৎ সংগঠন বৃহত্তর নোয়াখালী সোসাইটির সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয় । সংগঠনের সভাপতি নাজমুল হাসান মানিকের সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক ইউছুপ জসীমের পরিচালনায় সাধারণ সভায় সদস্যদের স্বতঃস্পূর্ত অংশগ্রহণে বার্ষিক আয়-ব্যায় প্রতিবেদন, ১২৬ একর জুড়ে কবরস্থানের তৃতীয় প্রকল্প অনুমোদিত হয়।
সাধারণ সভার মঞ্চে উপবিষ্ট ছিলেন বৃহত্তর নোয়াখালী সোসাইটির সাবেক সভাপতি ও বাংলাদেশ সোসাইটির সভাপতি আব্দুর রব মিয়া, সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদ মিন্টু, সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আবুল বাশার, সহ-সভাপতি তাজু মিয়া, ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হাজি মফিজুর রহমান, সদস্য খোকন মোশাররফ, রফিকুল ইসলাম ভূইয়া, সালামত উল্যাহ, রমেশ চন্দ্র মজুমদার, প্রফেসর করিম, আবু নাসের প্রমুখ।
শুরুতে পবিত্র কুরআন থেকে তেলওয়াত এবং দোয়া পরিচালনা করেন নিউকার্কের হযরত বেলাল (রাঃ) জামে মসজিদের খতিব ড. মুফতি সাইয়্যেদ মোহাম্মদ আনসারুল করিম (আল-আজহারী)। স্বাগত বক্তব্য রাখেন সভাপতি নাজমুল হাসান মানিক। সভাপতির বক্তব্যের পরই কোষাধ্যক্ষ মহিউদ্দিন দুই বছরের আর্থিক রিপোর্ট পেশ করেন। কোষাধ্যক্ষের রিপোর্ট অনুযায়ী বর্তমানে সংগঠনের ব্যাংক একাউন্টে রয়েছে তিন লাখ ৬ হাজার ৭৫৪.৬৭ ডলার। রিপোর্ট নিয়ে সবাই সন্তোষ প্রকাশ করেন। সাধারণ সভায় অডিট রিপোর্ট উপস্থাপন ও বক্তব্য রাখেন অডিট কমিটির আহবায়ক শাহ নাসের স্বপন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার হেলাল উদ্দিন, মাওলানা জয়নাল, সিএমবিবিএর প্রেসিডেন্ট রফিকুল ইসলাম পাটোয়ারি, আনোয়ার হোসেন লিটন, কোম্পানীগঞ্জ ওয়েলফেয়ার সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক মোশাররফ হোসেন সবুজ, জাহাঙ্গীর সরওয়ার্দী, মোস্তাফা কামাল পাশা বাবুল।
বৃহত্তর নোয়াখালী সোসাইটির ৩য় প্রকল্প “বাংলাদেশ সেমিটারী ও ফিউনারেল” সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির আহবায়ক ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদ মিন্টু বলেন, আমরা দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথমে ওয়াশিংটন মুসলিম মোমোরিয়ালে ৫০০ কবরের জায়গা ক্রয় করেছিলাম। সেই কবরের পুরো অর্থ আমরা পরিশোধ করি। যা ওই সময়ে কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। এখনো সেখানে আমাদের প্রায় ২৫০টির মতো কবর রয়েছে। কিন্তৃ মহামারি করোনার সময় আমরা মানুষের কষ্ট দেখেছি। সেই সময় অবশ্য নিউ ইয়র্ক বাংলাদেশ সোসাইটিসহ কয়েকটি সংগঠন এগিয়ে এসেছিল। তিনি বলেন, আমরা শুধু নোয়াখালীবাসীর কবরের জায়গা নিয়ে চিন্তিত নই, আমরা এখন পুরো বাংলাদেশি কম্যুনিটির কবরের দায়িত্ব নিতে চাই। আমরা ইতিমধ্যেই আপস্টেটে ১২৬ একর জায়গা ক্রয় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যেখানে প্রায় ১ লাখ মানুষের কবরের জায়গার ব্যবস্থা হবে। যদিও আমরা বেশ কয়েকটি জায়গা দেখেছিলাম, কিন্তু পরীক্ষা করার পর বাদ দিয়েছি। এখন আমরা যে জায়গা ক্রয় করছি ব্রুকলিন থেকে সেই জায়গার দূরত্ব ১ ঘণ্টা ৪৫ মিনিটের মতো। গত ৭ নভেম্বর আমরা এই জায়গার কনট্রাক্ট সাইন করেছি। গত ২২ জানুয়ারি ছিল ঐ শহরের টাউন প্ল্যানিং বোর্ডের সঙ্গে আমাদের বৈঠক। সেই বৈঠকে তারা সম্মত হয়েছে। ইতিমধ্যেই আমরা ডিজাইনার, ইঞ্জিনিয়ারসহ সবাইকে নিয়োগ দিয়েছি। কাগজপত্র পেলেই আমরা মাস্টার প্ল্যান নিয়ে কাজ শুরু করবো। আশা করি আপনাদের সহযোগিতা পেলে আগামী জুনের মধ্যে আমরা কবর দেওয়ার কাজ শুরু করতে পারবো। ১২৬ একরের জায়গাটি তিনভাবে বিভক্ত। একটি অংশে রয়েছে ৩২ একর। যেখানে ৪০ হাজার মানুষকে কবর দেওয়া যাবে। এই প্রকল্পের আগে আমরা ৫০৫ ম্যাকডোনাল্ড অ্যাভিনিউয়ের ৬ তলার বাড়িটিও ঋণমুক্ত করেছি। আমরা আগামী জুলাই মাসের মধ্যে ঐ জায়গায় কবর দিতে পারবো। এখন প্রয়োজন অতীতের মত আপনাদের সহযোগিতা। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন এগিয়ে এসেছেন। চুক্তি অনুযায়ী আগামী দুই মাসের মধ্যে আমাদের অর্থ পরিশোধ করতে হবে। আমাদের প্রয়োজন প্রায় ২ মিলিয়ন ডলার। ইতিমধ্যে আমরা হাফ মিলিয়ন ডলারে প্রতিশ্রুতি পেয়েছি। আশা করি আপনারা এগিয়ে আসবেন।
যা আছে বার্ষিক আয়-ব্যায় প্রতিবেদনে: ২০২২ এবং ২০২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে ৩১ জানুয়ারি ২০২৩ পর্যন্ত সোসাইটির বর্তমান স্থিতির পরিমান ৩ লাখ ৬ হাজার ৭৫৪ দশমিক ৬৭ ডলার বলে জানিয়েছেন কোষাধ্যক্ষ মহিউদ্দিন। যারমধ্যে ব্যাংকে রয়েছে ২ লাখ ৯৯ হাজার ৪৫৮ দশমিক ১৯ ডলার এবং নগদ হাতে রয়েছে ৭ হাজার ২৯৬ দশমিক ৪৮ ডলার।
প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রারম্ভিক স্থিতিসহ ২০২২ সালে সোসাইটির আয় ৯ লাখ ৯৫ হাজার ৭২৭ দশমিক ৭২ ডলার। ২০২২ সালে মোট ব্যায় ৭ লাখ ৯৮ হাজার ৫৬৪ দশমিক ২৯ ডলার।
প্রারম্ভিক স্থিতিসহ ২০২৩ সালে আয়ের পরিমান ৬ লাখ ৬৭ হাজার ২০০ দশমিক ০২ ডলার। এ বছর মোট ব্যায়ের পরিমান ৩ লাখ ৬০ হাজার ৪৪৫ দশমিক ৩৫ ডলার।
সদস্য ফি আদায়, বাড়ি ও অফিস ভাড়া থেকে আয়ের উল্লেখ করা হয়েছে। একই সাথে মৃত সদস্যদের দাফন, দ্বিতীয় ভবন ক্রয় সংক্রান্ত, দুটি ভবনের মেরামত, বিভিন্ন বিল পরিশোধসহ বিভিন্ন খাতে খরছ দেখানো হয়। যা উপস্থিত সদস্যরা অনুমোদন করেন।
প্রস্তাবনা এবং দাবি: প্রাণবন্ত প্রশ্নোত্তর ও আলোচনা পর্বে প্রবীন সদস্য আনোয়ার হোসেন নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় বলেন “সংক্ষেপে কেন্নে শেষ কোইরবো? কতদিন হরে আইচি, ম্যালা কতা রোই গেছে”। এসময় উপস্থিত সদস্যদের মধ্যে হাস্যরসের সৃষ্টি হয়। মৃতদের জন্য কবরস্থান ক্রয়ের উদ্যোগকে স্বাগত জানানোর পাশাপাশি জীবিতদের জন্যও কিছু উদ্যোগ গ্রহণের তাগিদ দেন তিনি। কমিউনিটি বড় হচ্ছে সন্তানদের বিয়েসহ নানান অনুষ্ঠানের আয়োজন করার লাগে। সেজন্য তিনি একটি কমিউনিটি সেন্টার স্থাপনের দাবি তোলেন।
একই দাবী ধ্বণিত হয় সেনবাগ সোসাইটির সভাপতি জাহাঙ্গীর সহরোয়ার্দীর কন্ঠেও। তিনি কবরস্থানের মেগা প্রকল্প এগিয়ে নেয়ার জন্য জাহিদ মিন্টুসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানান।
কোম্পানীগঞ্জ ওয়েলফেয়ার এসোশিয়েশনের সভাপতি মোশারফ হোসেন সবুজ পুরাতন সাধারণ সদস্যদের আজীবন সদস্য করার ওপর জোর দেন।
সভায় সদস্যরা প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে আসা তরুন-য্বুকদের সোসাইটির সদস্য হিসাবে অন্তর্ভূক্তির ওপর জোর দেন।
কবর নোয়াখালীবাসীর জন্য নয়, বাংলাদেশীদের জন্য: বৃহত্তর নোয়াখালী সোসাইটির ৩য় প্রকল্প “বাংলাদেশ সেমিটারী ও ফিউনারেল” পুরো বাংলাদেশী কমিউনিটিতে এখন আলোচিত মেগা প্রকল্প। এনিয়ে আহবায়ক জাহিদ মিন্টু বলেন ব্রুকলিন থেকে মাত্র ৬৫ কিলোমিটার দূরত্বে আপস্টেটে ১২৬ একর জুড়ে প্রকল্পে ১ লাখ কবরের জায়গা হবে। প্রকল্পটির সম্ভাব্য ব্যায় ৪ থেকে ৫ মিলিয়ন ডলার। তবে; সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন হলে ব্যায় বাড়তেও পারে। ইতোমধ্যে চুক্তি সম্পাদন হয়েছে।
এই প্রকল্পটি এগিয়ে নিতে বৃহত্তর নোয়াখালী কমিউনিটির পরিচিতজনরা ধার হিসাবে ১ লাখ ৫৭ হাজার ডলার দিয়েছেন। প্রতিশ্রুতি রয়েছে ৫ লাখ ডলারের।
তিনি আবেগতাড়িত কন্ঠে বলেন করোনাকালীন সময়ে আমরা কবরের সংকট দেখেছি। তাই এই প্রকল্পটি কিংবা কবর শুধু নোয়াখালীবাসীর জন্য নয়, কবর বাংলাদেশীদের জন্য।
সাবেক সভাপতি আব্দুর রব মিয়া বলেন, এটা আমাদের তৃতীয় নয় চতুর্থ প্রকল্প। প্রথম প্রকল্প ছিল প্রথম বাড়ি, দ্বিতীয় প্রকল্প করব, তৃতীয় প্রকল্প দ্বিতীয় পাতি এবং চতুর্থ প্রকল্প হচ্ছে বাংলাদেশ সেমিট্রি এবং ফিউনারেল হোম। আশা এই কাজেও আমরা সফল হবো এবং প্রবাসে নতুন ইতিহাস রচনা করবো। তিনি নোয়াখালী ভবনে ভ্রম্যমান কন্স্যুলেটে সেবা নিয়ে বলেন, আমরা গত সপ্তাহেও কন্স্যুলেট অফিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। যেখানে জাহিদ মিন্টুও ছিল। তারা আমাদের জানিয়েছে, তারা এখানে কন্স্যুলেট সেবা দেবে না। কে বা কারা অভিযোগ করেছে আমরা নাকি কন্স্যুলেট সেবার নামে অর্থ নিচ্ছি। এই মিথ্যা অভিযোগ আমরা খন্ডানোর চেষ্টা করছি।
নোয়াখালী সোসাইটির সেক্রেটারি ইউসুফ জসিম বৈরী আবহাওয়ায়ও বার্ষিক সাধারণ সভায় অংশগ্রহণের জন্য সবাইকে ধন্যবাদ জানানোর পাশাপশি যারা সদস্য হননি তাঁদের সদস্য হওয়ার তাগিদ দেন।
সভাপতি নাজমুল হাসান মানিক তাঁর স্বাগত ও সমাপনী বক্তব্যে বৃহত্তর নোয়াখালী সোসাইটির আজকের অবস্থানের জন্য বিগত সময়ে দায়িত্বপালনকারী সকল নেতৃবৃন্দ, বর্তমান কার্যনির্বাহী কমিটি এবং সকল সদস্যের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। নাহয় ১২৬ একর জুড়ে ১ লাখ কবরের এই প্রকল্প গ্রহণ সম্ভবপর হতো না।
ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হাজী মফিজুর রহমান একজন দুই জন বক্তার বক্তব্যের সমালোচনা করে বলেন, (আনোয়ার হোসেন লিটন) যারা কাজ করে তাদের সমালোচনা হয়। কিন্তু যারা কাজ করে না তাদের সমালোচনা হয় না। তাদের কাজই হচ্ছে সুযোগ পেলে সমালোচনা করা। কিন্তু কোন দিন সংগঠনের ফান্ডে কোন অর্থ দেয়নি। ভাল কাজে এগিয়ে আসেননি। এমনকি নিয়মিত চাঁদা দিয়ে সদস্য পদও রাখেননি। তিনি বলেন, জাহিদ মিন্টু আমাদের গর্ব। সে আছে বলেই এই কাজগুলো করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে। আমরা আরো জাহিদ মিন্টু চাই। তবে যারা সংগঠনের সদস্য নন, তাদের বক্তব্যের সুযোগ দেওয়ায় অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সভাপতি নাজমুল হাসান মানিক সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে সাধারণ সভার সমাপ্তি ঘোষণা করেন।