প্রবাসে বাঙালিদের উৎসব-অনুষ্ঠানে ভরপুর সারা বছর। আজকাল ফেসবুকের পাতা বলে দেয়, ১২ মাসে ১৩ পার্বণে প্রবাসীরা মাতোয়ারা। শুক্রবার থেকে রোববার হয় দাওয়াত, গ্র্যাজুয়েশন পার্টি নয় গানের আসর। যদি কিছুই না থাকে, তাহলে বন্ধুদের বিয়ে আড্ডা-গান-বাজনা। প্রবাস জীবন কি এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ? আমার কাছে তা মনে হয় না। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে যে মিশে আছে গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য, সাহিত্য ও শিল্পকর্ম। শত ব্যস্ততার মাঝেও প্রবাসীরা তাদের সাহিত্য ও শিল্পকর্মকে ধরে রাখতে নিচ্ছে নানা কর্মসূচি, যার অন্যতম হলো নিউইয়র্ক বইমেলা ও ডিসি বইমেলা। এই প্রাণের মেলা প্রবাসীদের কিছুটা হলেও একুশের বইমেলার স্বাদ এনে দেয়। বইমেলায় ছুটে আসেন লেখক ও প্রকাশক। অনেকটা মনের তাগিদে তারা আসেন। লাভ-লোকসানের ধার ধরেন না প্রকাশকেরা।
এবার দ্বিতীয়বারের মতো ‘আমরা বাঙালি ফাউন্ডেশন’ ওয়াশিংটনে আয়োজন করে ডিসি বইমেলা ২০১৯। আয়োজকদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পেরে আমি তৃপ্ত।
আয়োজনে কোনো কিছুর কমতি ছিল না। দেশ থেকে বইসহ ছুটে এসেছেন প্রকাশনী সংস্থার কর্মকর্তারা। স্থানীয় কিছু প্রকাশকদের দেখে বই প্রকাশের কিঞ্চিৎ সাহস পেয়েছে অনেক কবি-লেখক।
মেলায় উপস্থিত ছিলেন বরেণ্য সাহিত্যিক সেলিনা রহমান, আনিসুল হক, ড নুরুন নবী, শাহাব আহমেদ, আনিস আহমেদ, সাংবাদিক ইকবাল বাহার চৌধুরী, প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা সংস্করণের আবাসিক সম্পাদক ইব্রাহীম চৌধুরী প্রমুখ।
বইমেলায় ১১টি নতুন বই পরিচিতি ও লেখকদের সঙ্গে কথোপকথনের আয়োজন ছিল। এরা হলেন নুরজাহান বোস, আব্দুন নূর, এস মাহতাব আহমেদ, ওয়াহিদা আফজাল, মাহবুব সালেহ, সৈয়দ আল ফারুক, আশরাফ আহমেদ, হুমায়ুন কবির ঢালী, নূরন্নবী, হাসান মাহমুদ ও আনিসুল হক।
যাঁদের রিপোর্ট ও লেখা আমি নিয়মিত পড়ি তাদের মধ্যে দুজনকে একটু বেশি কাছে পেয়েছি। আলাপ হয়েছে বারবার।
পপি চৌধুরী। একজন লেখিকা, প্রকাশক ও ব্যবসায়ী। সব কর্মের মধ্যেও নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন লেখালেখি জগতে। সদা হাস্যোজ্জ্বল, সদালাপী এই মানুষটির সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে ডিসি বইমেলায়। তার আগে থেকেই তার লেখা পড়েছি প্রথম আলোতে। প্রীতম প্রকাশনী, প্রথমা ও স্বদেশ শৈলী পাশাপাশি স্টল থাকতে বেশির ভাগ সময় কেটেছে পপি ও শেলীর সঙ্গে। দুই দিনের বইমেলায় নানা বিষয়ে কথা হয়েছে। পপি তাঁর লেখা একটি বই ‘টান’ আমাকে উপহার দিলেন।
বইমেলা কমিটি পপির জন্য যতটুকু সমাদর করতে পেরেছে, তার চেয়ে বেশি তিনি বই মেলার জন্য করেছেন। শেষ দিনে পপি ও তার স্বামীর সঙ্গে এক ফ্রেমে বন্দী হলাম। আত্মার একটি সম্পর্ক থাকবে চিরকাল।
শেলী জামান খান। লেখিকা ও সাংবাদিক। প্রথম আলোর পাতার শেলীর লেখালেখির সঙ্গে পরিচয়। তিনি ডিসি বইমেলায় আসার আগে প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার আবাসিক সম্পাদক ইব্রাহীম চৌধুরী আমাকে ফোন করে বললেন, শেলী জামান খান আসবেন। তাঁকেও বলে দিলেন আমার কথা। শেলীর সঙ্গে প্রথম দেখা ভার্জিনিয়ার একটি আবাসিক হোটেলে। অসাধারণ সুন্দর মনের মানুষ। আমাকে দেখেই মিষ্টি একটি হাসি দিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় করলেন। এরপর দুই দিন প্রথম আলোর স্টলে ছিলাম একসঙ্গে। শেলীর কাছে যতবার গেছি মুখে ছিল মিষ্টি একটা হাসি। জানি এই দুই দিনে তাদের খুব কষ্ট হয়েছে, কিন্তু মুখের হাসি দেখে তা বোঝার উপায় ছিল না। চমৎকার একজন মানুষ। চুপচাপ থাকেন, কিন্তু কাজ করেন নীরবে। আপা তার একটি বই আমাকে উপহার দিলেন। আমার লাইব্রেরিতে যুক্ত হলো প্রিয় লেখকদের একটি বই। ভালো থাকবেন শেলী আপা।
পলি শাহিনার মুখটা বেজার দেখে জিজ্ঞেস করলাম বই কোথায়? বেচারি আক্ষেপ করে জানালেন, প্রকাশক তার বই আনতে ভুলে গেছেন।
কবি সেলিনা আক্তারের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। মৃদুল রহমানের ভুনা খিচুড়ি খেয়ে আমার ক্যামেরায় সেলিনাকে কিছু ছবি তুলে দিলাম। বুঝলাম, সেলিনার ছবি তোলার আগ্রহটা বেশি।
ফারহানা হোসেনকে প্রথম দিন দেখেছি, দ্বিতীয় দিনে উধাও।
ইব্রাহীম চৌধুরীকে এক পাইনি, সঙ্গে বোনাস হিসেবে পেয়েছি ভাবিকেও। ভাবির সঙ্গে টুকটাক কথা হলেও ইব্রাহীম চৌধুরী ব্যস্ত ছিলেন অন্যদের সঙ্গে।
মেলায় সর্বাধিক বই বিক্রি হয়েছে মৃদুল রহমানের ‘আমরা বাঙালি ও আমাদের বাঙালিত্ব’ বইটি। স্বদেশ শৈলী স্টলে মৃদুল রহমান বই নিয়ে বসেছিলেন।
কবি সাহিত্যিকদের সঙ্গে আড্ডার কুশল বিনিময়, সাহিত্য বিষয়ক কথামালায় ভিন্ন জগতে হারিয়ে গিয়েছিলাম।
এবারের আয়োজনে অতিথিদের আতিথেয়তায় কিঞ্চিৎ ঘাটতি দেখা গেছে। অনেকে হোটেলে রুম বিড়ম্বনায় ছিলেন। অতিথিদের কেউ খাদ্য কুপন পেয়েছেন, কেউ পাননি। এ বিষয়ে আয়োজক কমিটির দস্তগীর জাহাঙ্গীরের সঙ্গে কথা বলতেই তিনি মোস্তাফিজকে দেখিয়ে দিলেন। মোস্তাফিজ অতি সাদরে আমাকে দুটি খাদ্য কুপন ধরিয়ে দিলেন।
কবি/ছড়াকার সৈয়দ আল ফারুক ও নাহিদ নাজিয়ার অংশগ্রহণ আমাদের ভবিষ্যতের আয়োজনে উৎসাহ বাড়িয়ে দিয়েছে।
আশা করছি, ভবিষ্যতে আরও বেশি লেখকদের সমাগম ঘটবে এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের চেয়ে লেখক-প্রকাশক ও পাঠকেরা বেশি গুরুত্ব পাবে। তাহলে বলা যাবে, সত্যি এটাই বইমেলা।
লেখক : সুবীর কাস্মীর পেরেরা, প্রথম প্রকাশ : প্রথম আলো, ২৮ জুন ২০১৯