আমার দেখা বাবাদের মাঝে আমার বাবা ছিল পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বাবা। ছোট বেলা থেকেই আমি অত্যন্ত দুরন্ত ছিলাম কিন্তু আমার বাবাকে আমি প্রচণ্ড ভয় পেতাম। আমার বাবা আমাকে কাছে ডেকে ভালোবেসে দু’চারটা কথা বলেতেন কিংবা উপদেশ দিতেন আর আমি মাথা নিচু করে শুনতাম। আমার বড় ভাইদের শহরের বাড়ীতে রেখে পড়াশোনা করাতেন আর আমি থাকতাম গ্রামের বাড়ীতে এবং সেখানেই স্থানীয় স্কুলে লেখাপড়া করতাম।আমার বাবা শহরে কাপড়ের ব্যবসা করতেন এবং পাশাপাশি গ্রামে শতাধিক বিঘা জমি ছিল, সেগুলো নিজে চাষ করতেন ও বর্গা দিতেন। তখন আমাদের বাড়ীতে অনেক গরু মহিষও পালতেন।
আমাকে লেখাপড়ার পাশাপাশি এইগুলোও দেখভাল করতে হতো।তাই জমি চাষ, গরু মহিষ পালা সহ এমন কোন কাজ নেই আমাকে করতে হয় নাই। আমার বাবা শহরের দোকান শেষ করে গ্রামের বাড়ীতে ঢুকেই আমার নাম ধরে ডাকতেন অথবা মা কে বলতেন খালেক কোথায়। বাবা জোড়ে ডাক দিলেই আমি ভয়ে কাপতে থাকতাম। বাড়ীতে ঢুকেই আমাকে কোন না কোন কাজের অর্ডার করতেন। বাবার নির্দেশনা পালনসহ লেখাপড়ার বিষয়টি আমাকে খেয়াল রাখতে হতো। আমার বাবা আমার সাথে অনেক রাগ করতেন, বকা দিতেন কোন কাজে গাফিলতি উনার চোখে পড়লে। কিন্তু আমি উনার মুখ পানে চেয়ে কোন দিন একটি শব্দ উচ্চারণ করি নাই এবং কখনোই ভাবি নাই আমার বাবা আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করছেন বা অন্যায় করছেন। সব সময় ভেবেছি আমি অন্যায় করেছি বা করছি সেজন্যই আমাকে বকা দিচ্ছেন। তবে আমি বিশ্বাস করতাম আমার বাবা আমাকে অনেক ভালোবাসেন কিন্তু প্রকাশ ছিল না। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া পর্যন্ত আমার বাবা আমার কাছে এমনই একজন বাবা ও শাসক ছিল যাকে আমি প্রচণ্ড শ্রদ্ধা ও ভয় পেতাম। আমাকে লেখাপড়ার পাশাপাশি পরিবারের সব কাজ করতে বাধ্য করতেন এবং আমাকে সব কাজ করায়ত্ত করতে শিখিয়েছেন এবং যেকোন প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করার সাহস যুগিয়েছেন।
একদিন আমার কলেজের কয়েক বন্ধু এজাজ, ডাক্তার তুহিন, ইঞ্জিনিয়ার ওয়াদুদসহ কয়েকজন পাশের গ্রামে যাত্রাপালা দেখে ভোরে আমাদের গ্রামের বাড়ীতে এসে বাড়ীর গেট বন্ধ দেখে আমি আমার রুমে ঢুকতে পারি নাই। আমাদের বাড়ীর সাথে বৈঠকখানা ছিল, সেখানে আমার বাবা গ্রামের মানুষের বিচার শালিশ করতেন এবং মাঝে মাঝে অতিথিরা বা হুজুররা ঘুমাতেন, তাই একটি খাটও ছিল। তাই উপায়ান্তর না দেখে বাধ্য হয়েই সবাই একখাটে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। আমার বাবা প্রতিদিন ভোরে এসে এখানে ফজরের নামাজ আদায় করতেন কিন্তু সেদিন এসে রুম বন্ধ পেয়ে উনি বারান্দায় নামাজ আদায় করে সূর্য উঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করছেন, আর আমরা যাত্রা দেখে সবাই এমন ঘুমে বিভোর যে কখন সকাল হয়ে গেছে সেটা খেয়ালই নেই আর সবাই ঘুমের মাঝে যাত্রাপালার নর্তকীদের নাচের দৃশ্যগুলো স্বপ্নালোকে অবচেতন– সেই স্মৃতিগুলো এখনো তারিত করে। হ্ঠাৎ দরজায় লাঠির বাড়ির শব্দের আমরা সবাই জেগেই বুঝতে পারি আমার বাবা লাঠি দিয়ে দরজায় বাড়ি দিচ্ছে আর বলছেন ” দিবসে লাইট”! আমরা সবাই ভয়ে কাপতে শুরু করেছি আর আমার খুবই লজ্জা করছিল এই ভেবে যে আমার বাবা আমার কলেজের বন্ধুদেরকে এইভাবে অপমানিত করলো। আমার বাড়ির নিয়ম ছিল সূর্য উঠার আগে ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ আদায় শেষে লেখাপড়া শুরু করা। এখানে আমি একসাথে তিনটি অন্যায় করেছিলাম , এক – বাবা মায়ের অনুমতি ব্যতীত যাত্রাপালা দেখতে যাওয়া – যেটা তখন খুবই খারাপ কাজ হিসাবে বিবেচিত হতো, দুই – দেরিতে ঘুম থেকে উঠা যেটা একটি বদ অভ্যাস এবং তিন নাম্বার – আমি দিবসে লাইট জ্বালিয়ে বিদ্যুৎ বিল উঠাচ্ছি যাহা একটি অপচয়। এখন অবদি আমি এক মুহুর্তও বাবার সেই কথাগুলো ভুলতে পারি না। আমি ভোর চারটায় ঘুমালেও খুব সকালে আমার ঘুম ভেঙে যায়। আমি কোন্দিন একটি টাকাও অপচয় করি না।
আমার বাবা আমার কাছে একজন পীর ছিলেন, উনি ছিলেন আমার প্রান পুরুষ। আমি ঢাকাতে চাকুরী কালিন সময় থেকে ব্যবসায়ী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া পর্যন্ত মাঝে মাঝেই কুস্টিয়া থেকে ছুটে আসতেন আমার বাসায় আমাকে ও আমার বাচ্চাদের দেখতে। সবার কাছে গল্প করতেন আমার ছেলে ঢাকার বড় ব্যবসায়ী। আমার বাবার অসুস্থর কথা শুনলে আমি গাড়ীতে করে ঢাকায় নিয়ে আসতাম উনার চিকিৎসা করাতে। আমার বাবা যেদিন মারা যায় যেদিন আমি প্যারিস থেকে ট্রেনে জার্মানির ডুসেলডর্ফ হয়ে বিন্ডলাক যাচ্ছিলাম NKD বায়ারের সাথে মিটিংয়ে। আমার ছেলে অনিকের বয়স ছিল তখন তিন বছর।
আজকের আমি বাবারা কেমন আছে….।
ঘুম থেকে উঠে বাচ্চারা উঠলো কিনা সেটা খেয়াল করা, অনেক বাবাকে বাচ্চাদের ঘুম থেকে উঠানোর সাথে সাথে বাচ্চার মা কেও আদর করে উঠাতে হয় লক্ষীসোনা ডেকে। বাচ্চাদের স্কুলে ড্রপ দিয়ে বাসায় এসে অথবা রাস্তা থেকে একটি সেন্ডুইশ ও কফি নিয়ে অফিসে ছুটতে হয় আর যদি বৌ কোন কাজ করে তাকে ড্রপ করে গাড়িটি বাসায় রেখে বাসে কিংবা ট্রেনে নিজের কর্মস্থলে রওনা দিতে হয়, আবার কাজের ফাকে স্কুল থেকে বাচ্চাদের পিক আপ করে বাসায় ড্রপ দিতে হয়। আর ছেলে মেয়েরা একটু বড় হলে তাদের মুখে মুখ রেখে কথা বলার সাহস বাবারা হারিয়ে ফেলেছে। দু’চারটা উপদেশ দিতে গেলে ভদ্র ছেলে মেয়ে হলে মুখ ঘুরিয়ে যেতে যেতে বলবে ” I am busy Baba’’, অনেক বাবাকে উল্টো কটু কথাও শুনতে হয়। এখনকার বাবা সেকেলে , মাথায় বুদ্ধিশুদ্ধি নেই – সব সময় বাচ্চাদের বিরক্তের কারন।
বাচ্চারা বড় হলে অনেক মায়ের অত্যাধিক আদরে বাচ্চারা অনিয়ন্ত্রিত হয়ে উঠে। অনেক মা’ দের অতিরিক্ত আদর ভালোবাসা সন্তানকে অনেক ক্ষেত্রে কর্মহীন ও আলস করে তুলে। এই সমস্ত মা’ রা বুঝে না যে সন্তানের আসল মজ্ঞল কিভাবে হবে। আমরা এই বয়সে সূর্য উঠার পরে ঘুম থেকে উঠবো সেটা কখনো চিন্তাও করি না, আর এখনঅনেক বাচ্চা আছে সূর্য কখন ঊঠে সেটাই দেখতে পারে না। সারদিন ঘুমায় আর সন্ধ্যায় উঠে, আর আজকের মায়েরা আদর করে ডেকে রুমে খাবার দিয়ে আসে নতুবা মুখে তুলে খাওয়ায়ে দেই। আর বাবারা নিশ্চুপ চেয়ে চেয়ে দেখে আর দু:খ কস্টে একাকী কাঁদে, এই ক্রন্দন হাজার বাবার। বাবাদের শুধু চেয়ে চেয়ে দেখতে হবে কিছু বলতে পারবেন না, যদি কিছু বলতে যান তবে আপনি হবে পৃথিবীর সব চেয়ে Rude বাবা এবং একজন স্ত্রীর কাছে একজন খারাপ স্বামী।
আমি বাবার কোন চাওয়া পাওয়া নেই কোন সন্তানের কাছে। একটিই চাওয়া সন্তানেরা ভালো থাকুক।আজকের বাবারা সন্তানের কাছে একটি টাকা বা ডলার চাই না, ক্ষুধা পেলে নিজের টাকায় ও সামর্থ্যে খেতে পারে , অসুস্থ হলে নিজের খেয়াল নিজেই রাখতে পারে। অনেক সন্তান তাদের বাবা ও মায়েদের আমেরিকায় রেখে হোম কেয়ারের টাকায় সংসার চালায়। আমি বাবারা এমনই আছি, সন্তানদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশায় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে তাদের জন্য মহান আল্লাহর দরবারে দোয়া চেয়ে, উনি নিশ্চয়ই সন্তানের জন্য কোন বাবার হাত ফেরত দেন না। হাজার কস্ট বুকে চেপে আকাশ পানে চেয়ে মহান আল্লাহর উপর ভরসা রেখে যে একটি আলোকরশ্মি দেখতে পাই – আশার আলো আর সেটা দেখেই বাবারা বেঁচে আছে। এই আলোই একদিন বড় নক্ষত্র হয়ে বড় বড় প্রদ্বীপ প্রজ্জ্বলিত করবে , এই পৃথিবী জয় করবে। আমার সন্তানের খুশী সংবাদে আমার বাবার আত্মা আমাকে ডেকে কানে কানে বলবে ” আমার দোয়া সর্বদা তোমার উপর – এ আমার রক্ত , আমার বংশধর, আমার আনন্দধারা। আমিও হাসবো , খুশীতে বুকটা ভরে উঠবে। সেটা আমি সব সময় দেখি সন্তানের ভালো কোন খুশীর সংবাদে।
আমি বাবা এই সব কিছু নিয়েই বেশ আছি , মানুষ আশা নিয়েই বাঁচে। কখনওই হাল ছাড়াতে নেই।। আমার রক্ত আমার পানেই চেয়ে থাকবে – শতবার কেন!!! হাজার বার চেস্টা করা আমার রক্ত প্রবাহকে সঠিক ভাবে ধাবিত করা আমার দায়িত্ব।একদিন আমিও সবার সামনে গর্ব করে বলবো , আমার সন্তান পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ – শ্রেষ্ঠ ধনী।
লেখক: মহাম্মদ খালেক, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, নিউইয়র্ক









