আসছে ভাষার মাস, ফেব্রুয়ারি। প্রতিবছর ২১ শে ফেব্রুয়ারি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সকল বাঙালির কাছে একটি গৌরবের দিন। ভাষা শুধু বাঙালির আত্ম-অন্বেষণই নয়, তৈরি করেছে একে অপরের সাথে সেতু বন্ধন ও বন্ধুত্ব। সে সূত্র ধরেই বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে বাংলা কবিতার উৎসবে অংশগ্রহণ করতে গিয়েছিলাম।
১৮ জানুয়ারী শ্রুতিমুখ আবৃত্তি চর্চা কেন্দ্রের বার্ষিক অনুষ্ঠান হয়ে গেল মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে। শ্রুতিমুখ আবৃত্তি চর্চা কেন্দ্রের যাত্রা শুরু হয় ২০০৮ সালে পশ্চিমবঙ্গের আবৃত্তি শিল্পী নিবেদিতা চৌধুরীর নিরলস প্রচেষ্টায়। বর্তমানে এই আবৃত্তি চর্চা কেন্দ্রটি একটি সমৃদ্ধ প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত অনেকের কাছে। দেশি শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি রয়েছে অসংখ্য বিদেশি শিক্ষার্থী।
আমার সাথে নিবেদিতা চৌধুরীর পরিচয় হয় ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। আমি তার কণ্ঠে কবিতা শুনে এতটাই মুগ্ধ হই যে বার বার তার কাছে ফিরে যাই। তিনিও আমাকে সাদরে গ্রহণ করেন শ্রুতিমুখ পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে।
আমাদের বন্ধনের মূল জায়গাটি হল আমরা বাংলাভাষী এবং বাংলা কবিতা ভালোবাসি। সে কারণে শ্রুতিমুখ পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে গত ১৮ জানুয়ারী, বহরমপুরের রবীন্দ্রসদনে অনুষ্ঠিত বার্ষিক সভায় অংশগ্রহণ করি।
সেদিন বহরমপুরের আকাশ ঘন কুয়াশায় ঢাকা। প্রচণ্ড ঠান্ডার সাথে সারাদিন গুড়িগুড়ি বৃষ্টি। বার বার আকাশের দিকে তাকাই, অনুষ্ঠান হবে তো? মানুষ আসবে তো এই আবহাওয়ায়? এসব ভাবতে ভাবতেই ঘড়িতে বিকেল চারটা বেজে যায়। যথারীতি ঢাকা থেকে বয়ে নিয়ে যাওয়া শাড়িটি পড়ে, নিবেদিতা এবং আমি চলে যাই রবীন্দ্রসদনে। সন্ধ্যা ছয়টায় অনুষ্ঠান শুরু হবে, এরই মধ্যে খুদে শিল্পীরা জড় হয়েছে মেকআপ রুমে। তাদের বিড়াল সাজতে হবে। একে একে চলে আসে সব শিল্পীরা। সবাই তৈরি হয়ে যায় অনুষ্ঠানের জন্য।
অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগ মুহূর্তে শ্রোতাদের উপস্থিতি আমাদের সব ভাবনাকে বদলে দেয়। অনেকেই এসেছেন আবৃত্তি সন্ধ্যা উপভোগ করতে। অনুষ্ঠান চলাকালীন সময়ে তাদের করতালি উৎসাহিত করে খুদে ও বর্ষীয়ান আবৃত্তি শিল্পীদের। অনুষ্ঠানের শুরু হয় প্রদীপ প্রজ্বলনের মাধ্যমে এবং এর সাথে ধ্বনিত হয় কবিগুরুর ‘অন্তর মম বিকশিত কর অন্তর তর হে …’ ।
একের পর এক কবিতা আবৃত্তির মাধ্যমে একটি মনোজ্ঞ পরিবেশ তৈরি হয়। শিল্পীদের কণ্ঠে নারদ নারদ, হ্যাল্লো হ্যাল্লো হুল্লো বিল্লি, ছন্দে ছড়ায় মুর্শিদাবাদ, মা আমার মা, এমন কি আর খাই, অত্যাচারী রাজা পেলেন উচিত সাজা, যুদ্ধের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, কথা মানবী কবিতার মাধ্যমে উঠে আসে ছোটদের ছড়ার আনন্দ, মাতৃস্নেহের অবদান, মুর্শিদাবাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য, বর্তমান সময়ের যুদ্ধের অস্থিরতা ও এর বিরুদ্ধে প্রদিবাদ, এবং ভারতবর্ষে নারীবাদের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট।
অনুষ্ঠান শেষে পুরস্কার তুলে দেয়া হয় শিল্পীদের হাতে। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের মাধ্যমে পরিচয় হয় অনেক গুণী শিল্পীদের সাথে, এ যেন বাংলাভাষা, বাংলা কবিতা এবং বাংলাভাষীদের এক অপূর্ব মিলনমেলা।