সুব্রত কুমার দাস — আমার কাছে তিনি একটি আন্তর্জাতিক লেখকগ্রাম। তাঁর কথা সানন্দে লিখতে গিয়ে আমি প্রথমেই শেকড়মুখী হতে চাই।
আমার বাবা যাত্রাপালা লিখেছেন। লিখেছেন অষ্টকগান। লিখেছেন লোক ও ধর্মীয় গান। জীবিত লেখক বলতে প্রথমত আমি বাবাকেই জানতাম। খুব ছোটোবেলায় খুব সম্ভব আমাদের গ্রামের গীতিকবি অক্ষয় দাসকে দেখেছিলাম। তখন তাঁকে বুঝতে পারিনি। সেই কাঁচাশৈশবে চিনতে পারিনি কবিয়াল বিজয় সরকারকে।
বহু বছর পর আবিষ্কার করলাম, আমারই খুব কাছের একজন লেখক আছেন, প্রতিষ্ঠিত সুলেখক, গবেষক। তাঁকে আমি প্রথমত একজন সপ্রতিভ সুন্দরমুখ তরুণ হিসেবেই চিনতাম। জানতাম তিনি আমাদের কামারখালি হাইস্কুলের মেধাবী ছাত্র। পরবর্তীকালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে বিএ অনার্স এবং এমএ পাশ করে ঢাকার একটি সুপ্রতিষ্ঠিত কলেজে পড়ান। আর এই মেধাবী অগ্রজ তরুণের সুব্রত কুমার দাস।
একুশের বইমেলায় আমি বাংলাভিশন থেকে এবং আরটিভি থেকে বেশ কবছর লাইভ অনুষ্ঠান করেছি এবং সেখানে গর্বভরে তুলে ধরেছি লেখক সুব্রত কুমার দাসকে।
দুই.
প্রথমেই বলতে হবে মাটি থেকে শুধু গাছপালা শাকসবজি উদ্ভিদ আর ফসল ফলে না, বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত মাটি বা ভূমি থেকে মাঝে মাঝে লেখক কবি এবং মহৎ মানুষও জন্ম নেয়।
মধুমতি গড়াই চন্দনা ফুলেশ্বরী বড়োই স্নেহময়ী মমতাময়ী মাতৃনদী। পদ্মার শাখা নদীগুলোর পলিবাহিত জনপদ থেকে কত গুণী মানুষের জন্ম হয়েছে।
গড়াই নদীনামের সমাপ্তি যেখানে সেখানেই কামারখালি এবং নদীর নতুন নাম মধুমতি। নদী বন্দর গঞ্জ, রেল স্টেশন এবং পাট ব্যবসার জন্য বিখ্যাত কামারখালি শিল্পে সাহিত্যেও সমৃদ্ধ।
কামারখালির ইতিহাস নাইবা বলি, এবার তবে সুব্রত কুমার দাসের কথা বলি। বৈষ্ণব মা-বাবার সুসন্তান সুব্রত। বৈষ্ণব কে? সুব্রত কুমার দাস কি বৈষ্ণব? তিনিও কি বাড়ির পরিবেশ থেকে বৈষ্ণবীয় ভাবধারায় বেড়ে ওঠেননি? অথবা তিনি হয়তো সেই ভাবের প্রবহমাণতা থেকে একটু দূরেও সরে গিয়েছিলেন একসময়। তবুও তিনি দীক্ষিত বৈষ্ণব না-হলেও অবৈষ্ণব বলা যায় না।
লেখক সুব্রত কুমার দাসের বাড়িতে গুরু আসতেন। গুরুকে আমরা বলি গোসাঁই। আমিও কোনো এক গোসাঁইয়ের মুখ থেকে শুনেছিলাম—
‘যা দেবী সর্বভূতেষু বিষ্ণুমায়েতি শব্দিতা’
যে দেবী তিনি বিষ্ণুমায়াতেই বর্তমান।
শরণাগত, দীন, আর্ত — শরণাগতের সকল আর্তিই এই দেবী, যিনি নারায়ণের অংশভূতা, তিনিই পরিত্রাণ করেন বলে জেনেছি। শাক্ত, শৈব, গাণপত্য যাই বলি না কেনো সকলেই বৈষ্ণব।
বৈষ্ণব কে? মহাপ্রভু বলেছেন—
তৃণাদপি সুনীচেন
তরোরপি সহিষ্ণুনা
অমানিন মান দেন
কীর্তনীয়া সদা হরি।
যিনি তৃণের চেয়েও নীচু হতে পারেন, গাছের মতো সহ্যশক্তি যাঁর আছে, যিনি অমানীর মান বা সম্মান দিতে পারেন এবং সব সময় হরিনাম কীর্তন করেন তিনিই বৈষ্ণব।
এই কথাগুলো এখানে তুলে ধরার একটাই কারণ, শুদ্ধসজ্জায় সজ্জিত কপালে তিলকখচিত বৈষ্ণব না-হয়েও সুব্রত কুমার দাস বৈষ্ণবের সত্তায় আত্মায় উদ্ভাসিত সুলেখক।
সাহিত্য শব্দের মূলে হিত বা সহিত। হিতের জন্য সাহিত্যিক। আলো জ্বালাবার জন্য সাহিত্য, মানুষের চৈতন্য জাগানোর জন্য, জ্ঞানাঞ্জনের জন্য সাহিত্য। এবং সাহিত্য শব্দের যথার্থও পাওয়া যায় তাই বৈষ্ণববাড়ির সুসাহিত্যিক সুব্রত কুমার দাসের লেখায় এবং তাঁর ব্যক্তিগত জীবনাচরণে।
তিন.
ফরিদপুর জেলার মধুখালি উপজেলা শহরের পশ্চিমে চন্দনা নদীতীরে ধ্বংসস্তূপে পরিণত এক ইতিহাসখ্যাত গ্রাম আছে। সেই গ্রামের নাম কোড়কদী। আমরা নরকোণার মানুষ, কোড়কদীর উত্তরের গ্রাম। মুখে মুখে শুনতাম কোরকদি। ছোটোবেলায় নৌকাবাইচ দেখতে যেতাম কোড়কীদিতে। শুকনোর সময় গ্রাম থেকে হেঁটে হেঁটে ভাটিখাল পার হয়ে কোড়কদীর পাশ দিয়ে বাগবাড়ি যেতাম কার্তিক ঠাকুর আনতে।
ঠাকুমা বাবা-জেঠার কাছে কোড়কদী গ্রামের সুনাম শুনতাম। শুনতাম এই গ্রামের জমিদাররা অর্থাৎ সান্যাল পরিবারের সবাই ভারতে চলে গেছেন। তাঁরা জমিদার, বড়োলোক — এসবই শুনতাম। আর শুনতাম এই গ্রামের একজন নারী নীলিমা সান্যাল আকাশবাণী খবর পড়েন। যদিও পরে জেনেছি সেটি আসলে সত্য নয়। কিন্তু কখনও জানতাম না কোড়কদী গ্রামে ছিলেন কজন বিদগ্ধ লেখক।
সুব্রত কুমার দাস কোড়কদীকে নতুন করে সবার সামনে তুলে ধরলেন একদিন। এই গ্রামের ঐতিহ্য সংস্কৃতি সাহিত্য নিয়ে তিনি উৎসব সমাবেশ সেমিনার প্রকাশনাও করলেন। তাঁর লেখা থেকে জানতে পেলাম — দ্বিতীয় কলকাতা হিসেবে এককালে পরিচিত ছিল কোড়কদী গ্রাম। তাঁর সুবাদেই ফরাসি ভাষাসহ বহু ভাষায় পণ্ডিত অবন্তিকুমার সান্যালের সন্ধান পেলাম। জানলাম — মহাভারত-মঞ্জরীর লেখক বঙ্কিমচন্দ্র লাহিড়ী ছিলেন এই গ্রামের মানুষ। শুধু লেখক নন, এই গ্রামে ছিলেন তেভাগা আন্দোলনের নেতা অবনী লাহিড়ী।
সুব্রত কুমার দাস গ্রন্থিত ও সম্পাদিত কোড়কদী একটি গ্রাম বইটি পড়ে আমিও অনুপ্রাণিত হলাম। মনে হল, আমার লেখকসত্তার মধ্যেও আছে চন্দনা ফুলেশ্বরী নদী এবং কোড়কদীর শেকড়শক্তি ও প্রেরণা।
সুব্রত কুমার দাস আকস্মিকভাবে একজন লেখক হয়ে ওঠেননি। তিনি ফরিদপুর জেলার পশ্চিমপ্রান্তের একটি সমৃদ্ধ জনপদের বিদগ্ধ সম্পন্ন উজ্জ্বলতম গুণীজনদের উত্তরসূরী। সমাজ তথা রাষ্ট্রের কাঠামোগত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ভেতর দিয়ে তিনি বড়ো হয়েছেন কিন্তু বেড়ে উঠেছেন হারানো ক্ষয়িষ্ণু ঐতিহ্যকে ধারণ ও লালন করে অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে।
ঋদ্ধ লেখকদের প্রস্তুতিকাল থেকে। পূর্ণ পূর্ণিমার জন্যও যেমন প্রতিবার চাঁদকে প্রস্তুত হতে হয় দ্বিতীয় থেকে। শেকড়বিহীন শ্যাওলাজাতীয় লেখকরা কেবল জমাট বাঁধতে জানেন, স্বল্পস্রোতে তাঁরা জমাট বেঁধে জলের চলা রুদ্ধ করে নিজেকে প্রকাশ করতে চান এবং জলের তোড় বেড়ে গেলেও তাঁরা কালের গর্ভে ভেসে যান।
সুব্রত কুমার দাসের লেখকমানস তৈরি হয়েছে তাঁর শৈশব থেকেই।
আগেই বলেছি, সুব্রতদার পাঁচ বছর পরে আমি একই স্কুল কামারখালি হাইস্কুলে পড়েছি। হাইস্কুলের দুতিন শিক্ষকও ছিলেন সাহিত্যমনস্ক। বিশেষ করে আজ আমাদের প্রধান শিক্ষক আবদুর রাজ্জাককে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি। রাজ্জাক ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র। ফলে ক্লাস নাইন টেনে সুব্রতদা এবং আমি সাহিত্যের বিশ্বপাঠ কিছুটা হলেও পেয়েছিলাম আমাদের কিশোরকালে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেটা খুব ছড়ানো, ওর ভেতরটা ধরা খুব মুশকিল। সেই তুলনায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য চারুকলা এবং সংগীত বিভাগ কিছুটা আশ্রমিক। রাজশাহীর নিভৃতনিবাস লাইব্রেরি এবং শিক্ষকদের সহজসঙ্গ সুব্রত কুমার দাসকে লেখক হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে। ফলে ঢাকায় এসেও তিনি কেবল নিজে লেখক হতে চাননি, হতে চেয়েছেন লেখকসেবক তথা শিক্ষা ও সাহিত্যের সেবক।
চার.
২০০০ সাল থেকে ঢাকায় একটু একটু করে ইন্টারনেটের প্রসার হচ্ছিল। তখনও আমাদের ই-মেইল আইডি হয়নি। ওয়েবসাইট সম্পর্কে তখনও আমাদের জ্ঞান খুবই সীমিত। সেই সময় অর্থাৎ ২০০৩ সালে অনলাইনে অসামান্য একটি কাজ করলেন সুব্রত কুমার দাস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা ইন্সস্টিউটে সেই ওয়েবসাইটের উদ্বোধন হল। বাংলাদেশের উপন্যাস-সাহিত্য নিয়ে প্রথম একটি দ্বিভাষী ওয়েবসাইট হল – bdnovels.org – এইসব সেবামূলক কাজ করতে গেলে নিজের লেখালেখির সময় কমে আসে। কিন্তু সুব্রত কুমার দাসের মননে রয়েছে বৈষ্ণবীয় ত্যাগের ধারা, সেবার ব্রত, তাঁর ব্রত তাঁকে তো পালন করতেই হবে।
একইভাবে তিনি কাজী নজরুল ইসলামের শতবার্ষিকীতে কাজ করেছেন। নজরুলশতবর্ষে সুব্রত কুমার দাস ক্রমশ প্রকাশিত হতে থাকেন। ২০১২ পর্যন্ত সুব্রত কুমার দাসের প্রকাশিত বইয়ের তালিকা থেকে বোঝা যায় তিনি মোটা দাগ ও মাপের লেখক নন।
নজরুলের ‘বাঁধনহারা’ (২০০০), বাংলা কথাসাহিত্য: যাদুবাস্তবতা এবং অন্যান্য (২০০২), নজরুল বিষয়ক দশটি প্রবন্ধ (২০০৩), বাংলাদেশের কয়েকজন ঔপন্যাসিক (২০০৫), প্রসঙ্গ : শিক্ষা এবং সাহিত্য (২০০৫), আমার মহাভারত (২০১০), রবীন্দ্রনাথ: কম-জানা, অজানা (২০১১), অগ্রন্থিত মোজাফফর হোসেন (সম্পা. ২০১১), কোড়কদী একটি গ্রাম (সম্পা. ২০১১), সেকালের বাংলা সাময়িকপত্রে জাপান (২০১২), রবীন্দ্রনাথ : ইংরেজি শেখানো (২০১২), রবীন্দ্রনাথ ও মহাভারত (২০১২), জাপান প্রবাস (সম্পা. ২০১২)।
পাঁচ.
১৯১৩ সালে মোট আটাশ জনের নাম নোবেল পুরস্কারের জন্য প্রস্তাবিত হয়েছিল। এই তথ্যটি আমার জানা ছিল না, জানা ছিল না সে বছর ফরাসি লেখক পিয়েরে লতি এবং আর্নেস্ট লেভিসের নাম সেই তালিকায় ছিল। এইসব তথ্য জানার পর রবীন্দ্রনাথের নোবেল বিজয় যেন আরও গৌরবের হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথকে আরও গভীরভাবে জানার এটা একটা পথ, আর এই পথ নির্মাতাদের একজন লেখক গবেষক সুব্রত কুমার দাস।
তাঁর ‘রবীন্দ্রনাথ কম-জানা, অজানা’ বইটা পড়ার পর মনে হল, অজানারে জানালেন তিনি। “শুরু হল কবিজীবন। ভগ্নহৃদয় হয়ে সন্ধ্যাসংগীত। সাথে আছে বউঠাকুরাণীর হাট। বেদনাতাড়িত যে আবেগ সেটি বদলাতে শুরু হলো প্রভাতসংগীতে পর্বে এসে। বিশ্বপ্রকৃতির আনন্দকে যেন হঠাৎ কবি ফিরে পেলেন। নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ হল যেন।”
সুব্রত কুমার দাসের ভাষা সহজ গতিময়, সুন্দর। বিষয়ের ভারনত নয় তাঁর লেখা। বোধগম্য সবটুকু। পাঠের আনন্দ তাঁর বাক্যে বাক্যে। নিরস তথ্যভারাক্রান্তও নয় তাঁর কোনো রচনা। জানার আনন্দে ভেসে যাওয়া যায় লেখকের সঙ্গে। শত শত বই খুঁজে খুঁজে খুঁটে খুঁটে পড়ার ধৈর্য থাকে না আমারও। লেখক সুব্রত কুমার দাস সেই ধৈর্য ধরতে প্রাণিত করেন তাঁর লেখায়। ‘রবীন্দ্রনাথ কম-জানা , অজানা’ রবীন্দ্র অনুরাগীর জন্যেই শুধু নয়, খুব সাধারণ পাঠকের জন্যও বইটি আনন্দ-সহায়ক।
ছয়.
২০১৩ খ্রিস্টাব্দ। আমি তখন ঢাকায়, গানবাংলা টেলিভিশন তখন হাতছাড়াপ্রায়। একটু অস্থিরতার মধ্যে ছিলাম; জানতেই পারিনি কবে সপরিবারে সুব্রতদা পাড়ি জমিয়েছেন কানাডায়। যেদিন নিশ্চিত হলাম তিনি আর দেশে নেই, বুকের মধ্যে গরম হাওয়া বইছিল কিছুক্ষণ। ঢাকায় সুব্রতদার সান্নিধ্য যে খুবএকটা পেতাম তা নয় কিন্তু কারণে অকারণে মাঝে মাঝে কথা হত। মাথার উপরে একজন দেশি অগ্রজ আছেন ভেবে একটু শক্তি পেতাম। সেদিন খুব মনমরা হয়েছিলাম। মাত্র একবছর পরেই অর্থাৎ ২০১৪ সালের অক্টোবরে আমিও একজন বাধ্যপ্রবাসী হলাম।
সুব্রত কুমার দাস কানাডায় এবং আমি ফ্রান্সে। কানাডায়ও ফরাসি ভাষা সাহিত্যের চর্চা আছে ভেবে তাঁকে আমার থেকে খুব দূরবর্তী মনে হল না। ২০১৫ সালে যোগাযোগ হল। আমরা তখন প্যারিস ছেড়ে আলেসে। আলেসের বাড়িতে প্রথম ডাকযোগে বই এল শ্রৗচৈতন্যদেব।
আমি তখন চরম মৃত্যুভাবনায় নিমজ্জিত। আমার স্ত্রীর কেমোথেরাপি শুরু হয়েছে। ঘুম হয় না, সারা রাত পড়ি শ্রীচৈতন্যদেব।
অতএব অবশ্য আমি সন্ন্যাস করিব ।
সন্ন্যাসিবুদ্ধ্যে মোরে প্রণত হইব॥
শ্রীচৈতন্যের সন্ন্যাসী হবার প্রেক্ষিতটা যে সুখকর ছিল না সে-কথা সবাই জানি না। আমিও নতুন করে জানলাম সুব্রত কুমার দাসের বই থেকে। সান্ত্বনা পেলাম। আবিষ্কার করলাম, মহাপ্রভু কেবল সন্ন্যাসী নন, তিনি সন্ন্যাসী সুরসৈনিক। তিনিই যেন সিদ্ধার্থ, গৌতমবুদ্ধ। সন্ন্যাসগ্রহণ মানে ত্যাগের ব্রতগ্রহণ। বীরই ত্যাগী হন, ভক্তের থাকে অশ্রুত্যাগ।
সুব্রত কুমার দাসের শ্রীচৈতন্যদেব কেবল জীবনী নয়, গবেষণাগ্রন্থ। মহাপ্রভুকে নিয়ে শত সহস্র রচনা আছে আমার জানা ছিল না। জানলাম— সুব্রত কুমার দাস চরম পরিশ্রমী লেখক। তিনি সৎ লেখক। অমিমাংসিত কোনোকিছু তিনি লিখতে চান না। শুদ্ধ সিদ্ধান্তে পৌঁছনো অব্দি তিনি অনুসন্ধানে রত থাকেন।
শ্রীচৈতন্যদেব গ্রন্থের সহায়কগ্রন্থতালিকা পড়েও আমি লেখকের প্রতি আরও শ্রদ্ধেয় হয়ে উঠলাম।
‘পাষাণ সমান কঠিন হৃদয়
সেহ শুনি গলি যায়।’
শ্রীচৈতন্যদেব পাঠের পর আমার বিচলন অনেকখানি কমে গেল। বুকের মধ্যে জমাটি পাষাণভার লঘু হয়ে গেল। চৈতন্যদেবকে মনে হল সর্বজনীন করে তোলা হল। শুধু ভক্তের জন্য সকল পাঠকের জ্ঞানপাঠ হয়ে উঠল শ্রীচৈতন্যদেব।
লেখক লিখেছেন তিনি ভাবগত হতে পারেননি। কিন্তু তিনি তাঁর ভাবের অভাবও রাখেননি। ভক্তি না থাকুক, ভাব আর ভাবনা না থাকলে কোনো রচনা উৎকৃষ্ট হয়ে ওঠে না।
সাত.
সুব্রত কুমার দাসের সব বই আমার পড়া হয়নি, কিন্তু তাঁর জীবনকে যেন আমি অনেকখানি পড়তে পেরেছি। লেখককে গভীরভাবে জানতে হলে মানতে হলে বুঝতে হলে তাঁর জীবন ও কর্মটাকেও জানা লাগে। কোনো লেখকই তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের আলো অন্ধকার থেকে বিচ্ছিন্ন নন। সুব্রত কুমার দাসও তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের দীপ্তি ও বেদনানন্দকে তাঁর লেখালেখি থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন রাখেননি। তাঁর সাক্ষাৎকারমূলক বই ‘উৎস থেকে পরবাস’ পড়ে তাঁর জীবনের বাঁক এবং অবাককে জানা হল।
দেবাঞ্জনা মুখার্জি ভৌমিকের আলাপনে ভিন্নস্বাদের এক আত্মলিপি রচিত হল। আলাপনের সহজ সরস ও প্রজ্ঞাপূর্ণ প্রশ্নে দেবাঞ্জনা লেখকের মুখ থেকে চরম ও পরম সত্য উচ্চারণ করিয়ে নিয়েছেন।
একজন সাহিত্যসেবক সংগঠক কর্মী এবং সঞ্চালক সুব্রত কুমার দাসকে খুব সহজেই চেনা যায় উৎস থেকে পরবাস বইয়ে।
মুক্তিযুদ্ধ রাজাকার আলবদর আলশামস এবং একাত্তরের শরণার্থী এবং অবশ্যই স্বদেশ ও প্রবাস যাপনের নানান দিক নিয়ে কথা বলেছেন লেখক। তাঁর বলার মধ্যে বিশ্লেষণ আছে, শ্লেষও আছে খুব সূক্ষ্মভাবে।
করোনাকালে সুব্রতদাকে নতুনভাবে পেয়েছি। সহজ মানুষ লাইভ অনুষ্ঠানে যুক্ত করার সুবাদে আমরা তাঁকে আরও নিকটতম স্বজন এবং হিতৈষীরূপে পেয়েছি। কিন্তু করোনাকালে আমার মতো তিনিও বন্ধুর পাশাপাশি অবন্ধুকেও নতুন করে চিনেছেন। উৎস থেকে পরবাসে তিনি বলেছেন— “করোনাপূর্বকালে যে মানুষ বন্ধু ছিল, করোনার সময়ে সে শত্রু হয়েছে। মানে কতখানি পীড়াদায়ক অস্তিত্ব সে।’’
কথাগুলো বড়ো বেদনার মতো বেজেছে আমারও প্রাণে। করোনার উৎকণ্ঠার মধ্যে সুব্রতদার ব্যক্তিগত কষ্টটাও আমাকে ভাবিয়েছে, তাঁর জীবনের সত্য আমার জীবনেও মিথ্যা নয়।
আট.
সুব্রত কুমার দাসের কানাডীয় সাহিত্য বিচ্ছিন্ন ভাবনা বইটি এখনও ভালোভাবে পড়া হয়নি। তাঁর আমার মহাভারত আরও কয়েকবার না-পড়ে কিছু লেখা অনুচিত বলে মনে করি। নজরুল-বীক্ষা বইটি নিয়ে আমি আর কী লিখব, বিদগ্ধ কেউ না কেউ অন্য বইগুলো নিয়ে এবং লেখকের জীবন নিয়ে লিখেছেন। আমি কেবল আমার ভালোবাসা শ্রদ্ধাটুকু আবেগভরে উল্লেখ করলাম।
একজন কলম-সচল লেখক ষাট বয়স পূর্ণ করে এগিয়ে চলেছেন কেবল নতুন জন্মদিনের দিকে নয়, তিনি চলেছেন আরও নতুনতর বিষয়বৈচিত্র্যপূর্ণ আনন্দজ্ঞানময় রচনার দিকে। আমি তাঁর রচনা থেকে আরও আরও ঋদ্ধ হব। তিনি লেখক ও পাঠকদের কাছে নির্ভরযোগ্য সত্যান্বেষী আস্থাঋদ্ধ সুসাহিত্যিকরূপে চিরনন্দিত হবেন। সুব্রত কুমার দাসকে আমার আনত অভিবাদন।
লেখক : রবিশঙ্কর মৈত্রী, লেখক, কবি, ভাষা ও আবৃত্তিকর্মী, আলেস, ফ্রান্স।