কানাডা জার্নালের মূল উদ্দেশ্য তিনটি – কানাডার বিভিন্ন প্রান্তে থাকা লেখকদের মধ্যে সংযোগ তৈরি করা; কানাডার মূলধারার সাহিত্যিকদের সাথে বাঙালি লেখকদের সেতুবন্ধ নির্মাণ করা; এবং কানাডায় জন্ম নেওয়া বা বেড়ে ওঠা বাঙালি সন্তানদের মধ্যে বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের ব্যাপারে আগ্রহ তৈরি করা।
এই তিন লক্ষ্যকে সামনে নিয়ে গত ২০ জুলাই টরন্টোর শহরের স্কারবোরো এলাকার সেন্ট পল ইউনাইটেড চার্চে অনুষ্ঠিত হয় কানাডীয় বাঙালি সাহিত্য উৎসব। ভ্যাঙ্কুভার, হ্যালিফ্যাক্স, মন্ট্রিয়ল, অটোয়া, কিংস্টন, ওয়াটারলু এবং গ্রেটার টরন্টো ও আশেপাশের শহরগুলোর বাঙালি লেখকদের নিয়ে আয়োজিত এই সাহিত্য উৎসবকে কেন্দ্র করে টরন্টোর সাপ্তাহিক বাংলা মেইল পত্রিকা একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে।
– Advertisement –
উৎসবের শুরুতেই বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে নিহত ছাত্রদের সম্মানে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। উপস্থিত কবি-লেখকেরা সাহিত্য নিয়ে আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে প্রকাশ করেন বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে বিপুল সংখ্যক ছাত্র-জনতা হত্যায় তাদের তীব্র প্রতিবাদ।
ছয় ঘন্টাব্যাপী এই সাহিত্য উৎসবের উদ্বোধনী পর্বে উপস্থিত ছিলেন টরন্টো শহরের তিন খ্যাতিমান ইমেরিটাস পোয়েট লরিয়েট অ্যান মাইকেলস, এ এফ মরিৎস এবং জর্জ এলিয়ট ক্লার্ক।
লেখক ও উপস্থাপক সামিনা চৌধুরীর পরিচালনায় উদ্বোধনী পর্বে স্বাগত বক্তৃতা দেন কানাডা জার্নালের উদ্যোক্তা সুব্রত কুমার দাস। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া বিপুল সংখ্যক ছাত্র হত্যার তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করেন তিনি। তার আহবানে নিহত ছাত্রদের প্রতি সম্মান দেখিয়ে উপস্থিত লেখকবৃন্দ দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন। বাংলাদেশের ঘটনাবলীর কারণে ক্ষুব্ধ ও বিষণ্ণ থাকলেও অনুষ্ঠান চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা তুলে ধরেন অন্যতম আয়োজক সুব্রত। তিনি জানান, এমন একটি পূর্ব নির্ধারিত আয়োজনে কবি-লেখকেরা তাদের প্রতিবাদ জানানোর সুযোগ পাবেন সেটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া এই আয়োজন থেকে সম্ভব ছিল টরন্টো তথা কানাডার সাহিত্যের তিন অভিভাবককে প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশের ঘটনাবলী নিয়ে বাঙালি কবি লেখকদের প্রতিক্রিয়া জানানোর। একই সাথে এই আয়োজন সারা কানাডার বাংলাভাষী সব লেখকের প্রতিবাদের মঞ্চ হয়ে উঠবে বিবেচনা করেই অনুষ্ঠান চালিয়ে নিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
এই আয়োজনের মিডিয়া পার্টনার হিসেবে ছিল কানাডার প্রথম চব্বিশ ঘন্টার টেলিভিশন চ্যানেল এনআরবি এবং জনপ্রিয় সাপ্তাহিক বাংলা মেইল। এই দুই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার বিশিষ্ট সাংবাদিক শহিদুল ইসলাম মিন্টু তার বক্তব্যে দেশের পরিস্থিতিতে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
উদ্বোধনী পর্বে এই বছরে প্রকাশিত সকল গ্রন্থের লেখকদের মঞ্চে ডেকে উপস্থিত দর্শকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। এসময় টরন্টো শহরের তিন খ্যাতিমান ইমেরিটাস পোয়েট লরিয়েট অ্যান মাইকেলস, এ এফ মরিৎস এবং জর্জ এলিয়ট ক্লার্কের মতো কানাডীয় সাহিত্যের তিন খ্যাতিমান সাহিত্যিকের উপস্থিতি বাঙালি লেখকদেরকে উৎসাহিত করে তোলে।
এরপর সাপ্তাহিক বাংলা মেইলের বিশেষ সংখ্যায় যে লেখকদের লেখা প্রকাশিত হয়েছে তাদেরকে মঞ্চে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, কানাডার ২৭টি বিষয় নিয়ে কানাডায় থাকা ২৭ জন লেখক প্রবন্ধ লিখেছেন এই সংখ্যায়। বিশেষ সংখ্যার অতিথি সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন সুব্রত কুমার দাস।
পোয়েট লরিয়েটদের পর্বটি শুরু হয় বিকেল সাড়ে পাঁচটায়। পরিচালনা করেন বিশিষ্ট অনুবাদক শ্রেয়সী বোস দত্ত। কানাডার তিন খ্যাতিমান সাহিত্যিককে মঞ্চে পরিচয় করান বাঙালি কমিউনিটির তিন নন্দিত লেখক ও অনুবাদক। অ্যান মাইকেলসকে নিয়ে কথা বলেন বিশিষ্ট ইয়েটস গবেষক সুজিত কুসুম পাল। এ এফ মরিৎসকে নিয়ে কথা বলেন মরিৎসের কবিতার অনুবাদক মম কাজী এবং জর্জ এলিয়ট ক্লার্ককে নিয়ে বলেন লেখক ও উপস্থাপক তাসমিনা খান।
সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় শুরু হয় প্রবন্ধসাহিত্য নিয়ে পর্বটি। এতে সভাপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন চিন্তক আকবর হোসেন। অংশ নেন অটোয়ার লেখক ড. ঝর্ণা চ্যাটার্জী, সুধীর সাহা, ইসলামী চিন্তাবিদ হাসান মাহমুদ, বাংলা একাডেমী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ পুরস্কারপ্রাপ্ত কথাশিল্পী ও চিত্রী সৈয়দ ইকবাল এবং হ্যালিফ্যাক্স থেকে আগত গদ্যকার অতনু দাশ গুপ্ত।
এরপর বিকাল ৭.৩০টায় শুরু হয় কাব্যসাহিত্য পর্ব। এতে সভাপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন কবি ও উপস্থাপক শেখর ই গোমেজ। তাঁর সাথে যুক্ত হন ভ্যঙ্কুভার থেকে আগত নন্দিত সাহিত্যিক শাহানা আকতার মহুয়া, কবি কাজী হেলাল, মন্ট্রিয়ল থেকে আগত বরেণ্য চিত্রশিল্পী ও কবি রাকীব হাসান এবং অটোয়া থেকে আগত কবি সুলতানা শিরীন সাজি।
কথাসাহিত্য পর্বটি শুরু হয় সন্ধ্যা সাড়ে আটটায়। সভাপ্রধানের দায়িত্বে ছিলেন বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার, বাংলা একাডেমী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ পুরস্কার, এবং জেমকন পুরস্কারপ্রাপ্ত কথাসাহিত্যিক সালমা বাণী। তাঁর সাথে যে কথাকারেরা যুক্ত হন তাঁরা হলেন মন্ট্রিয়ল থেকে আগত নাহার মনিকা, জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন, রোকসানা পারভীন শিমুল এবং ওয়াটারলুর লেখক সুশীল পোদ্দার।
ছয় ঘন্টা ধরে চলমান এই আয়োজন যেমন ছিল সাহিত্যসেবীদের একান্ত চিন্তা ও ভাবনার ভাবনার প্রকাশ, তেমনি সেটি হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে সংঘঠিত হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদ মঞ্চ।
অনুষ্ঠানে ছিল বাংলা ভাষা ও সাহিত্য এবং বাঙালির ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে প্রবাসে বেড়ে ওঠা কিশোর-তরুণদের জন্য কুইজ। এই পর্বটি শুরু হয় বিকেল ৫টায়। পরিচালনায় ছিল সৌরাদৃতা ভৌমিক এবং সৌরদীপ ভৌমিক। ইংরেজি ভাষায় এই কুইজ পর্বটি পরিচালিত হয় কাহুত মাধ্যমে। বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার দেন জনপ্রিয় আইনজীবী ব্যারিস্টার ওমর হাসান আল জাহিদ।
আয়োজন স্থলে নিচতলার গ্রন্থকুঞ্জে উপস্থিত সকল লেখকের জন্য ছিল নির্ধারিত চেয়ার। লেখকেরা যাতে তাদের বই প্রদর্শন ও বিক্রয় করার সুযোগ পান এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে ভাব বিনিময়ের সুযোগ পান তার জন্যেই ছিল এই ব্যবস্থা।
পুরো অনুষ্ঠানটি এনআরবি টেলিভিশনের জন্য উপস্থাপন করেন জনপ্রিয় উপস্থাপক মাহবুব ওসমানী।
উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বাংলা মেইলের বিশেষ সংখ্যাটি যে লেখকদের রচনায় সমৃদ্ধ হয়েছে তাঁরা হলেন (বর্ণানুক্রমে) অতনু দাশ গুপ্ত, অসীম ভৌমিক, আকবর হোসেন, কাজী হেলাল, চয়ন দাস, জাকারিয়া মুহম্মদ ময়ীন উদ্দিন, জান্নাতুল নাইম, ড. ঝর্ণা চ্যাটার্জী, ড. দিলীপ চক্রবর্তী, দেবাঞ্জনা মুখার্জি ভৌমিক, প্রতিমা সরকার, মনীষ পাল, মম কাজী, মানসী সাহা, রতন সাহা, রেশমা মজুমদার শম্পা, রোকসানা পারভীন শিমুল, রোকসানা লেইস, শাহানা আকতার মহুয়া, শেখর ই গোমেজ, সোনালী রায় এবং স্বপন দেব। এছাড়া অনুষ্ঠানে উপস্থিত তিন পোয়েট লরিয়েটের সাহিত্য নিয়ে লিখেছেন সুজিত কুসুম পাল, সামিনা চৌধুরী, তাসমিনা খান।
বিশেষ সংখ্যা বিষয়ে অতিথি সম্পাদক সুবত বলেন, কানাডার – বিশেষ করে টরন্টোর – বাঙালিদের, বিশেষ করে নবাগত বাঙালিদের কথা চিন্তা করেই এই সংখ্যাটির পরিকল্পনা করা। নবাগত বাংলাভাষী মানুষেরা যাতে কানাডার বিভিন্ন বিষয়ে মাতৃভাষায় সাধারণ ধারণা লাভ করতে পারেন, সেটিই এই সংখ্যার লক্ষ্য। তিনি আরও বলেন, এই সংখ্যাতে যেমন কানাডার ভূগোল এবং ইতিহাস রয়েছে, তেমনি রয়েছে চিকিৎসা ব্যবস্থা ও প্রকৌশল ব্যবস্থার কথা। যেমন এতে কানাডার কৃষি বা ফুল নিয়ে আলোচনা রয়েছে, তেমনি রয়েছে রাজনীতি আর অভিবাসন আইন নিয়েও লেখাও। সংখ্যাটি যে কোনো বাঙালির জন্য এক আবশ্যিক পাঠ হবে বলে সুব্রত আশা করেন। তিনি আরও জানান স্থানাভাবে পূর্বাশা চৌধুরী, ননীগোপাল দেবনাথ, শ্রেয়সী বোস দত্ত, সামিনা চৌধুরী, সুশীল কুমার পোদ্দারের রচনা বর্তমান সংখ্যায় অন্তর্ভুক্ত করা যায়নি। আগামী সংখ্যাতে সেগুলো প্রকাশিত হবে। অভিবাসীর দেশ কানাডার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কানাডায় থাকা বাঙালি অভিবাসী লেখকের রচনায় সমৃদ্ধ এই সংখ্যাটি বাঙালি পাঠককে বাংলা ভাষায় কানাডা সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা দিতে সক্ষম হবে বলে পত্রিকাটির সম্পাদক বিশিষ্ট সাংবাদিক শহিদুল ইসলাম মিন্টু জানিয়েছেন।
উদ্বোধনী কানাডা জার্নালের ওয়েবসাইটের উদ্বোধনের কথা থাকলেও সেটি সাম্প্রতিক নেট দুর্যোগের কারণে সম্ভব হয়নি বলে জানানো হয়। শিঘ্রই এই ওয়েবসাইট হোস্ট করা হবে বলে জানা যায়। জানানো হয় এই ওয়েবসাইটে থাকবে সারা কানাডাজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বাঙালি লেখকদের পরিচয় ও লেখালিখি-বিষয়ক তথ্যাদি। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় উপস্থাপিত এই ওয়েবসাইটে কানাডার নাগরিক বা পিআরপ্রাপ্ত সেই সব লেখকের তথ্য উপস্থাপন করা হবে যাঁদের অন্তত একটি বই প্রকাশিত হয়েছে।